হাযির-নাযির এর প্রমাণ
নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লী ওয়া নুসাল্লিমু ‘আলা রসূলিহিল করীম
ওয়া ‘আলা- আ-লিহী ওয়া সাহবিহী আজমা‘ঈন
============
শরীয়তের পরিভাষায়, অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন সত্তা যদি এক জায়গায় অবস্থান করে সমগ্র বিশ্বকে আপন হাতের তালুর মতো দেখতে পান এবং দূরের ও কাছের আওয়াজ-আহ্বান শুনতে পান অথবা একই মুহূর্তে গোটা বিশ্বের ভ্রমণ করতে সক্ষম হন, শত শত ক্রোশ দূরে অবস্থানরত সাহায্যপ্রার্থী কিংবা সহযোগিতার মুখাপেক্ষী লোকদের প্রয়োজন বা চাহিদা পূরণ করেন, তিনিই ‘হাযির-নাযির’। এ অর্থে, ‘হাযির-নাযির’ গুণটি আল্লাহর ক্ষমতাদানক্রমে, বিশ্বনবী আমাদের আক্বা ও মাওলা হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও অন্যান্য নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম, এমনকি বুযুর্গানে দ্বীনেরও। এর পক্ষে ক্বোরআন-ই করীম, সহীহ হাদীসসমূহ ও বিজ্ঞ আলিমদের অভিমত ইত্যাদি অকাট্য ও গ্রহণযোগ্য প্রমাণাদি রয়েছে।
কিন্তু এক শ্রেণীর লোক নির্বিচারে বলে বেড়ায়-‘হাযির-নাযির’ হওয়া একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলারই গুণ ও বৈশিষ্ট্য; তাই এ গুণ আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো জন্য সাব্যস্ত করা ‘শির্ক ফিস্ সিফাত’ (গুণাবলীতে আল্লাহর সাথে শির্ক করা)’র সামিল; অথচ সর্বত্র সশরীরে ‘হাযির-নাযির’ হওয়া আল্লাহর গুণ বা বৈশিষ্ট্য হতে পারেনা, কারণ তিনি ‘শরীর’ থেকে এবং একস্থানে হাযির হয়ে অন্যত্র ‘গায়ব’ বা অনুপস্থিত হওয়া থেকে পবিত্র। অবশ্য তিনি (আল্লাহ) ‘সর্বত্র বিরাজমান’। তা এ অর্থে যে, সর্বত্র তাঁর জ্ঞান (ইল্ম) ও ক্ষমতা বিরাজমান। সৃষ্টির সর্বাপেক্ষা বৃহৎ বস্তু থেকে আরম্ভ করে অণু-পরমাণু পর্যন্ত কোন সৃষ্টিই তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়, সবকিছু সম্পর্কে তিনি স্বত্তাগতভাবে ও সরাসরি অবগত।
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমান- اِنَّ اللهَ لاَ يَخْفَىْ عَلَيْهِ شَئٌ فِى الْاَرْضِ وَلاَ فِى السَّمَاءِ (নিশ্চয় আল্লাহ্র নিকট কোন কিছু গোপন নয় যমীনে, না আসমানে) আর প্রতিটি সৃষ্টির উপর তাঁর ক্ষমতা বিরাজিত। কোন ‘বস্তু’ই তাঁর আওতা বহির্ভূত নয়। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমান- اِنَّ اللهَ عَلى كُلِّ شَئْءٍ قَدِيْرٌ নিশ্চয় আল্লাহ্ যা চান সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান।
‘হাযির’ ও ‘নাযির’ (حاضر و ناظر) দু’টি আরবী শব্দ। উভয় শব্দের আভিধানিক অর্থ নিম্নরূপঃ
‘হাযির’ (حاضر)-এর আভিধানিক অর্থ- যে বা যিনি সামনে উপস্থিতি, অর্থাৎ গায়ব বা অনুপস্থিত নয় বা নন। অভিধানগ্রন্থ ‘আল-মিসবাহুল মুনীর’-এ এর ব্যবহার এভাবে দেখানো হয়েছে- حَضَرَ الْمَجْلِسَ اَىْ شَهِدَه অর্থাৎ সে মজলিসে হাযির হয়েছে। حَضَرَ الْغَائِبُ حُضُوْرًا قَدِمَ مِنْ غَيْبَتِه অর্থাৎ অনুপস্থিত ব্যক্তি হাযির বা উপস্থিত হয়েছে, সে তার অনুপস্থিতির অবসান ঘটিয়ে (সামনে) এসে গেছে। ‘মুন্তাহাল আরব’-এ উল্লেখ করা হয়েছে- حاضر حاضر شونده অর্থাৎ ‘হাযির’ মানে ‘উপস্থিত হয়েছে এমন লোক’।
‘নযির’ (ناظر)-এর আভিধানিক অর্থ একাধিক- চোখে দেখে এমন লোক (প্রত্যক্ষকারী, অবলোকনকারী), চোখের মণি, দৃষ্টিপাত করা, নাকের রগ, চোখের পানি। ‘আল-মিসবাহুল মুনীর’-এ উল্লেখ করা হয়েছে-
وَالنَّاظِرُ السَّوَادُ الْاَصْغَرْ مِنَ الْعَيْنِ الَّذِىْ يُبْصِرُ بِهِ الْاِنْسَانُ شَخْصَه
অর্থাৎ ‘নাযির’ হচ্ছে চোখের ওই ছোট্ট কাল অংশ, যা দ্বারা মানুষ নিজে দেখে, অর্থাৎ চোখের মণি।
‘ক্বামূসুল্ লুগাত’-এ উল্লেখ করা হয়েছে-
وَالنَّاظِرُ السَّوَادُ فِى الْعَيْنِ اَوِ الْبَصَرُ بِنَفْسِه وَعِرْقٌ فِى الْاَنْفِ وَفِيْهِ مَاءُ الْبَصَرِ
অর্থাৎ ‘নাযির’ হচ্ছে- চোখের কালো অংশ (মণি) অথবা স্বয়ং দেখা, নাকের শিরা (রগ)। তা’তে আরো আছে ‘চোখের পানি’।
‘মুখ্তারুস্ সিহাহ্’তে ইবনে আবূ বকর রাযী বলেন-
اَلنَّاظِرُ فِى الْمُقْلَةِ السَّوَادُ الْاَصْغَرُ الَّذِىْ فِيْهِ اَنْسَانُ الْعَيْنِ
অর্থাৎ ‘নাযির’ মানে চোখের মণি, চোখের অভ্যন্তরে ছোট্ট কালো অংশ।
সুতরাং যতদূর পর্যন্ত আমাদের দৃষ্টিশক্তি কাজ করে ততদূর পর্যন্ত আমরা ‘নাযির’ (দ্রষ্টা, দৃষ্টিপাতকারী)। আর যে স্থান পর্যন্ত আমাদের ক্ষমতা চলে ততটুকু স্থানে আমরা ‘হাযির’। যেমন- আসমান পর্যন্ত আমাদের দৃষ্টিশক্তি কাজ করে, আমরা আসমান পর্যন্ত দেখতে পাই। কাজেই, আসমান পর্যন্ত আমরা ‘নাযির’ ‘দ্রষ্টা’ বা প্রত্যক্ষকারী); কিন্তু আমরা সেখানে ‘হাযির’ নই; কারণ, সেখানে আমাদের ক্ষমতা নেই। আর ঘরে কিংবা কামরায় আমরা মওজুদ থাকি, সেখানে আমরা ‘হাযির’; কারণ, ওখানে আমরা সশরীরে পৌঁছে গেছি, আমাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করি।
‘হাযির-নাযির’-এর পারিভাষিক অর্থ
এ বিশ্বে ‘হাযির-নাযির’-এর অর্থ শরীয়তের পরিভাষায় নিম্নরূপ-
‘‘ওই খোদাপ্রদত্ত পবিত্র বা অলৌকিক শক্তির অধিকারী ব্যক্তিই ‘হাযির-নাযির’, যিনি এক স্থানে অবস্থান করে সমগ্র বিশ্বকে নিজের হাতের তালুর মতো দেখতে পান, দূর ও নিকটের আওয়াজ-আহ্বান শুনতে পান, এক মুহূর্তে সমগ্র বিশ্ব ভ্রমণ করতে পারেন, শত-সহ¯্র মাইল কিংবা ক্রোশ দূরে অবস্থানকারীর প্রয়োজন বা চাহিদা পূরণ করতে পারেন। তাঁর এ গতি ও নিরেট রূহানী (আত্মিক) হোক কিংবা এ জড় জগতের দেহ সহকারেও হোক, অথবা ওই দেহ সহকারে হোক, যা কবরে দাফন করা হয়েছে অথবা অন্য কোথাও মওজুদ থাকুক।’’
উল্লেখ্য যে, এ ‘হাযির-নাযির’ গুণ বা বৈশিষ্ট্য আল্লাহ্ তা‘আলার অনুগ্রহক্রমে সম্মানিত নবীগণ এবং ওলীগণেরও। এর সপক্ষে পবিত্র ক্বোরআন ও হাদীস শরীফ এবং বিজ্ঞ আলিমদের অভিমত অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য দলীল হিসেবে পাওয়া যায়। [সূত্র. জা-আল হক্ব ও শানে মোস্তফা বযবানে মোস্তফা ইত্যাদি]
দু’টি উদাহরণ
আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর ওলীগণ তথা তাঁর প্রিয় বান্দাগণ যে ‘হাযির-নাযির’- এ বিষয়ের পক্ষে পবিত্র ক্বোরআন, হাদীস ও বিজ্ঞ আলিম-ইমামদের অভিমতগুলো উল্লেখ করার পূর্বে নিম্নোক্ত দু’টি সঠিক ও সত্য ঘটনা উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছি। এ দু’টি ঘটনা আলোচ্য বিষয়টি অনুধাবনে সহায়ক হবে-
এক. ‘ক্বসীদা-ই বোর্দাহ্’ শরীফের রচয়িতা অকৃত্রিম ও অনন্য আশেক্ব-ই রসূলের নাম আজ প্রায় সর্বজন বিদিত। তাঁর রচিত ‘ক্বসীদাহ্ বোর্দাহ্’ শরীফের নামকরণ ও রচনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কেও প্রায় সবাই জানেন। এর মহান রচয়িতা হলেন আল্লামা শরফ উদ্দীন মুহাম্মদ বূসীরী মিশরী (৬০৮/১২১৩-৬৯৫/১৩০০)। তিনি আরবীর বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানসমুদ্র ছিলেন। আরবী অলংকার শাস্ত্র (ফাসাহাত ও বালাগাত)-এ তিনি ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ। আরবী সাহিত্যে ছিলো তাঁর বিশ্বজোড়া খ্যাতি। সর্বোপরি, তিনি ছিলেন অকৃত্রিম আশেক্বে রসূল। এক রাতে তিনি হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে সাহাবা-ই কেরামের একটি নূরানী জমা‘আত সহকারে স্বপ্নে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেন। এরপর থেকে তাঁর মধ্যে নবী করীমের প্রতি ইশক্ব-ভালবাসা আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। নবীপ্রেমে বিভোর হয়ে তিনি এরপর কয়েকটা ‘ক্বসীদা’ (কাব্য বিশেষ) লিখে ফেলেন। তাঁর প্রসিদ্ধ ‘ক্বসীদাহ্-ই মুদ্বারিয়াহ্’ ও ‘ক্বসীদাহ-ই হামাযিয়্যাহ্’ তাঁর ওই সময়েরই রচনা।
এরপর তিনি একদিন হঠাৎ পক্ষাঘাত (অর্দ্ধাঙ্গ) রোগে আক্রান্ত হয়ে যান। তাঁর শরীরের অর্দ্ধেকাংশ অনুভূতিহীন হয়ে যায়। এমন কঠিন মুসীবতের সময় তাঁর মনে এ আগ্রহই জাগলো যে, তিনি হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রশংসায় একটি ‘ক্বসীদা’ লিখবেন আর সেটার মাধ্যমে নবী করীমের আরোগ্য-নগরীর দ্বারপ্রান্তে নিজের জন্য আরোগ্য ভিক্ষা চাইবেন। সুতরাং তিনি ওই অবস্থায়ই এ ‘ক্বসীদাহ্ শরীফ’ (ক্বসীদাহ্-ই বোর্দাহ্ শরীফ) রচনা করেন। বলাবাহুল্য, এ ক্বসীদাহ্ শরীফে তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রশংসা করেছেন অতি উন্নত মানের আরবী কাব্যে। প্রশংসাগুলোও অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য প্রমাণ ভিত্তিক। তৎসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর হাবীবের মহান দরবারে তাঁর রোগমুক্তি ও উভয় জাহানের সাফল্য চেয়েছেন অত্যন্ত কোমল ভাষায়; অতি সংগোপনে।
আলহামদু লিল্লাহ্! আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর হাবীবে করীমের মহান দরবারে তাঁর ক্বসীদাটি ও তাঁর ফরিয়াদ কবুল হয়েছে। ক্বসীদা রচনা সমাপ্ত করে তিনি যথানিয়মে শু’য়ে পড়লেন। ওই রাতেই তাঁর অনন্য সৌভাগ্যের নক্ষত্র উদিত হলো। তিনি মসীহে কাউনাঈন, শিফা-ই দারাঈন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে স্বপ্নযোগে সাক্ষাৎ লাভ করে ধন্য হন। তিনি বলেন, ‘‘আমি ওই স্বপ্নে আমার রচিত কবিতাখানা হুযূর-ই আক্রামের সামনে পাঠ-আবৃত্তি করেছি। ক্বসীদাটার পাঠ সমাপ্ত করার পরক্ষণে আমি দেখতে পেলাম, সরকার-ই দু’আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমার অসুস্থ দেহাংশের উপর তাঁর অনুপম নূরী ও বরকতময় হাত বুলাচ্ছেন। ইত্যবসরে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখ খুলতেই আমি আমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ পেলাম।’’ সুবহা-নাল্লা-হিল ‘আযী-ম।
তাছাড়া, এ ক্বসীদাহ্ শরীফের পাঠাবৃত্তি সমাপ্ত করার পর হুযূর-ই আক্রাম আপন বরকতময় বুর্দে ইয়ামানী (ইয়ামনী চাদর শরীফ) ইমাম বূসীরীর উপর রাখলেন। আর সাথে সাথে তিনি সুস্থ হয়ে গেলেন।
[ত্বী-বুল ওয়ার্দাহ্ শরহে ক্বসীদা-ই বোর্দাহ্]
ইমাম বূসীরী আলায়হির রাহ্মাহ্ বলেন, ‘‘এ খুশীতে আমি পরদিন ভোর বেলায় আমার ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। পথিমধ্যে শায়খ আবুর রাজা সিদ্দীক্ব (আলায়হির রাহমাহ্)-এর সাক্ষাৎ পেলাম। তিনি ওই যুগের ক্বুত্ববুল আক্বত্বাব ছিলেন। তিনি আমাকে বলতে লাগলেন, ‘‘হে ইমাম, আমাকে ওই ক্বসীদা পড়ে শুনান, যা আপনি হুযূর-ই আক্রামের প্রশংসায় লিখেছেন।’’ ইমাম বূসীরী বলেন, যেহেতু এ ক্বসীদা শরীফ সম্পর্কে আমি ব্যতীত তখনও অন্য কেউ অবগত হয়নি, সেহেতু আমি তাঁর খিদমতে আরয করলাম, ‘‘হযরত, আপনি কোন ক্বসীদাহ্ চাচ্ছেন। আমি তো হুযূর-ই আক্রামের শানে একাধিক ক্বসীদা রচনা করেছি।’’ শায়খ আবুর রাজা বললেন, ওই ক্বসীদাহ্ শুনান, যার প্রারম্ভ এভাবে করেছেন-
اَمِنْ تَذَكِّرُ جِبْرَانٍ بِذْىِ سَلَم ـ مَزَجْتَ دَمْعًا جَرى مِنْ مُّقْلَةٍ بِدَم
আমি আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললাম, ‘‘হে আবুর রাজা, আপনি এ ক্বসীদা কোত্থেকে মুখস্থ করলেন? আমি এ ক্বসীদা আমার আক্বা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত এ পর্যন্ত অন্য কাউকে শুনাইনি!’’ হযরত আবুর রাজা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বললেন, ‘‘হে বূসীরী, আমি গতরাতে এ ক্বসীদা তখনই শুনেছি, যখন আপনি সেটা হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে পড়ে শুনাচ্ছিলেন। আর হুযূর-ই আক্রামও তা শুনে অত্যন্ত খুশী হয়েছিলেন।’’ একথা শুনে আমি তৎক্ষণাৎ তাঁকে এ ক্বসীদা দিয়ে দিলাম। এরপর থেকে গোটা শহরে সেটার খবর প্রসিদ্ধ হয়ে গেলো। আর আজ তো এ ক্বসীদার চর্চা বিশ্বজোড়া।
এখানে লক্ষ্যণীয় যে, ইমাম বূসীরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তখন অবস্থান করছিলেন মিশরে আর আল্লাহ্র হাবীব তাশরীফ রাখছিলেন মদীনা মুনাওয়ারায়, রওযা-ই আন্ওয়ারে। এ ঘটনাও ঘটেছে হুযূর-ই আক্বদাসের ওফাত শরীফের প্রায় ৬০০ বছর পর। ইমাম বূসীরী এ ক্বসীদা রচনা করেছেন ও সেটার মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনাও করেছেন অতি সংগোপনে, তাঁর বদ্ধ কামরায়। আর তৎক্ষণাৎ এ ফরিয়াদ সম্পর্কে জেনে ও শুনে হুযূর-ই আক্রাম মদীনা শরীফ থেকে সুদূর মিশরে তাশরীফ আনয়ন করে তাঁকে হাত মুবারক বুলিয়ে দিয়ে সুস্থ করেছেন এবং চাদর শরীফ দান করেছেন। সুবহা-নাল্লাহ। এটাইতো বিশ্বনবী আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর ‘হাযির-নাযির’ হবার এক অকাট্য প্রমাণ। [সূত্র: ত্বীবুল ওয়ার্দ্দাহ্ শরহে ক্বসীদাহ্-ই বোর্দাহ্]
দুই. হযরত শায়খ আবদুল হক্ব হারীমী প্রমুখ বর্ণনা করেছেন- ৩ সফর, ৫৫৫ হিজরী। আমরা হুযূর গাউসুল আ’যম (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু)’র মাদরাসায় হাযির ছিলাম। আমরা স্বচক্ষে দেখছিলাম যে, হযরত গাউসে আ’যম ওযূ করছিলেন। ইত্যবসরে তিনি তাঁর বরকতময় পদযুগলের গীলানী খড়ম দু’টি একের পর এক করে বাতাসে নিক্ষেপ করলেন। অমনি ওই খড়ম যুগলও বাতাসে অদৃশ্য হয়ে গেলো। কারো সাহস হলোনা এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার। সবাই নিশ্চুপ ছিলাম। এর ২৩ দিন পর অনারবীয় অঞ্চল থেকে একটি কাফেলা আসলো। তারা এসে হুযূর গাউসে পাকের মহান দরবারে তাঁর খড়ম দু’টি আর কিছু ‘নযর-নেয়ায’ পেশ করলো। আর আরয করলো, ‘‘আমরা এক পাহাড়ী পথ অতিক্রম করছিলাম। হঠাৎ ডাকাতদল আমাদের উপর হামলা করে দিলো। আমাদের কয়েকজন লোক তাদের হাতে নিহত হলো। ডাকাতগণ আমাদের কাফেলার মাল-সামগ্রী লুণ্ঠন করতে লাগলো। আমরা যখন তাদের হামলা প্রতিহত করতে অক্ষম হয়ে গেলাম, তখন আমাদের প্রত্যেকে উচ্চস্বরে আহ্বান করলাম, اَغِثْنِىْ يَا شَيْخُ عَبْدُ الْقَادِرْ (হে শায়খ আবদুল ক্বাদির, আমাকে সাহায্য করুন) আর কিছু মান্নত করে নিলাম। এর পরক্ষণে ওই অরণ্যে এক ভয়ঙ্কর শব্দ শোনা গেলো, সেটার গর্জনে সমগ্র অরণ্য যেন কেঁপে উঠলো। তখন এ একটা খড়ম শরীফ ডাকাত-সর্দারের মাথার উপর এসে পড়লো। সেটার আঘাতের চোটে সর্দার মারা গেলো। এরপর অপর খড়মটি আরেক বড় ডাকাতের মাথায় পড়লো। সেও মারা গেলো। এটা দেখে পূর্ণ ডাকাত দলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। সুতরাং তারা আমাদের সমস্ত মালামাল ফেলে পালিয়ে গেলো। আমরা খড়ম যুগল দেখে চিনে ফেলেছি। এগুলো তো গীলান শহরের বরকতমণ্ডিত খড়ম। সুতরাং আমরা খড়ম দু’টি সযতেœ কুঁড়িয়ে নিয়ে আমাদের নিকট সংরক্ষণ করলাম, আর মান্নত অনুসারে হাদিয়া এবং ওই খড়মযুগল নিয়ে মহান দরবারে হাযির হয়েছি।’’ [সূত্র. বাহজাতুল আসরার]
এখানেও লক্ষণীয় যে, হুযূর গাউসে আ’যম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বাগদাদ শরীফে আপন মাদরাসায় সদয় অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকে অনেক দূরে অনারবীয় অঞ্চলের গভীর অরণ্যে বিপদগ্রস্ত ব্যবসায়ী কাফেলা তাঁর সাহায্য চেয়ে আহ্বান করলো। এদিকে হুযূর গাউসে পাক তাদের ফরিয়াদ শুনেছেন। আর ঘটনাস্থল দেখে দেখে খড়ম যুগল যথাস্থানে নিক্ষেপ করেছেন। কাঠের খড়ম উড়ে গিয়ে ডাকাতদ্বয়কে এমন জোরে আঘাত করলো যে, চোটে তারা নিহত হলো। এ নির্ভুল ঘটনাও ওলীকুল শিরমণি হুযূর গাউসে পাকের ‘হাযির-নাযির’ হবার পক্ষে আরেক অকাট্য প্রমাণ হলো। সুবহা-নাল্লাহ্।
এখন দেখুন- নবী ও ওলীগণ ‘হাযির-নাযির’ মর্মে পবিত্র ক্বোরআন, হাদীস শরীফ এবং ইমাম ও বিজ্ঞ ওলামার অভিমতসমূহ থেকে প্রণিধানযোগ্য দলীলাদি। তারপর বিরুদ্ধবাদীদের লেখনী ও বক্তব্য থেকে এর সপক্ষে প্রাপ্ত প্রমাণাদির উদ্ধৃতি আর পরিশেষে বিরুদ্ধবাদীদের বিভিন্ন আপত্তির খণ্ডন। সুতরাং এ প্রস্তুক দু’টি অধ্যায়ে বিন্যস্থ করা হলো, প্রথম অধ্যায়ে আবার পাঁচটি পরিচ্ছেদ রয়েছে, আর দ্বিতীয় অধ্যায়ে বিরুদ্ধবাদীদের নয়টি আপত্তির খণ্ডন করা হয়েছে।
(সংগৃহীত)